বিশেষ প্রতিবেদন :
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং তার পরিবার ভুয়া বা বেনামী কোম্পানির নামে নেওয়া ঋণের অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশে ও দেশের বাইরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এই তথ্য উঠে এসেছে।
তদন্তে আরও দেখা গেছে, সাইফুলের কয়েকজন সহযোগী যার মধ্যে তার সাবেক গৃহকর্মী ও তার স্বামীও রয়েছেন, তারাও তাদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের বাইরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং বিদেশে অর্থপাচার করেছেন।
এছাড়াও দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে সাইফুল ও তার সহযোগীদের একটি চক্র শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও গাজীপুরেই ১৩০ একরেরও বেশি জমি কিনেছে। এসব জমির দলিলমূল্য প্রায় ৩২৫ কোটি টাকা। তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে এসব জমির বাজারমূল্য এর কয়েক গুণ।
বেশিরভাগ জমি—প্রায় ৭৭ দশমিক ৭ একর কেনা হয় ২০১৯ সালে। পরের বছর সাইফুল আলম আরও ১৫ একর জমির মালিক হয়েছেন বলে দুদকের মানি লন্ডারিং তদন্তে উঠে এসেছে।
মোট ১৩০ একরের মধ্যে প্রায় ৪৭ একর জমি কেনা হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়, যা সাইফুল আলমের নিজ এলাকা।
তদন্তকারীদের পর্যালোচনা করা জমির দলিল অনুসারে, এসব জমির মালিকানায় রয়েছে এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড (১২ একর), এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড (৮ একর) এবং এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড (৮ একর)।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টার-কে দুদকের উপপরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আদালতের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এসব সম্পত্তি জব্দ করেছি। এখন আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী একজন রিসিভার নিয়োগ করা হবে।’
তবে রিসিভার নিয়োগে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ দুদক বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং তার শাসনামলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে।
দুদকের অনুসন্ধান এবং সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১৫ বছরে এস আলম একের পর এক ব্যাংক দখল করেছেন এবং এসব ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। কিছু ক্ষেত্রে কেবল কাগজে কলমে এসব কোম্পানির নাম থাকলেও বাস্তবে নেই।
গত ৮ এপ্রিল দুদকের উপপরিচালক তাহসিন মুনাবিল হক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ১৪ ধারার আওতায় এস আলম, তার সহযোগীদের এবং প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন কিছু সম্পত্তি জব্দের অনুমতি চেয়ে ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে আবেদন করেন।
দুদক তার আবেদনে আরও জানায়, এসব সম্পত্তি হস্তান্তর বা হাত বদলের চেষ্টা চলছে তাই তদন্ত ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুনরুদ্ধারের স্বার্থে সম্পত্তিগুলো জব্দ করা জরুরি।
আদালত চট্টগ্রাম ও গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এবং সাব-রেজিস্ট্রারদের এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত তার সহযোগীরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে বেনামী ঋণ নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং দেশে এবং বিদেশে তার এবং তার পরিবারের নামে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন।
চলতি বছরের ২৫ মার্চ দুদকের করা মামলায় বলা হয়েছে, সাইফুল ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এবং অন্যান্য স্থানে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
এই মামলাটি ৮ এপ্রিল আদালতে জমা দেওয়া আবেদনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন তদন্তকারী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কিছু আইনি জটিলতার কারণে এস আলম এবং তার পরিবারের বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করার জন্য দুদক এখনও আবেদন করেনি।
তিনি বলেন, ‘যখন আমরা কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিদেশে সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ চাই, তখন সেই আদেশ কার্যকর হবে কিনা তা সেই নির্দিষ্ট দেশের আইনের ওপর নির্ভর করে। কারণ আমাদের এখতিয়ারে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত কোনো কাজ সেখানে সেভাবে বিবেচিত নাও হতে পারে।’
উদাহরণ তুলে ধরে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে অবৈধ অর্থ স্থানান্তর আমাদের মানি লন্ডারিং আইনের অধীনে অপরাধ। কিন্তু সিঙ্গাপুরে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য নাও হতে পারে কারণ তারা সেই অর্থকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখে।’
এছাড়াও, এস আলম ২০২০ সালে তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন এবং তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।
একজন ধনী গৃহকর্মী
এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ২৬২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধে আদালতের আদেশও চেয়েছিল দুদক।
তদন্তকারীরা দেখেছেন যে, এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ২৯টি মরজিনা আক্তারের নামে, যিনি একসময় এস আলমের বাসায় গৃহকর্মী ছিলেন। তদন্তের সময় এই অ্যাকাউন্টগুলোতে ১ কোটি ৯ লাখ টাকারও বেশি জমা ছিল। অন্যদিকে আরও ১০টি অ্যাকাউন্ট মরজিনার স্বামী সাদ্দাম হোসেনের নামে। পরিবর্তীতে এই দম্পতি ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ আছে ২০১৭ সালে এস আলম বন্দুকের মুখে ব্যাংকটি দখল করেছিলেন।
তদন্তের সময় এস আলমের সহযোগী আলমাস আলী এবং অন্যদের কমপক্ষে ২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা জমা ছিল বলে দুদকের আবেদনে উঠে এসেছে।
দুদকের তদন্তে প্রাপ্ত নথি অনুসারে, এস আলমের আত্মীয়স্বজন এবং সহযোগীদের নামে ভুয়া ঋণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এই অর্থ তখন দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়েছিল, যা মানি লন্ডারিং আইন লঙ্ঘন করে এবং জ্ঞাত উৎসের আয়ের বাইরে বিপুল সম্পদের সঞ্চয় ঘটিয়েছে।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে, দুদক মনে করে যে সাইফুল আলম ও তার পরিবার সম্প্রতি কিছু নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ স্থানান্তর বা হস্তান্তরের চেষ্টা করেছে, যা তদন্ত শেষ হওয়ার আগে সম্পদগুলো হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।’
আদালত বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে এসব অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে, দুদক এখন পর্যন্ত সাইফুল আলম এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৫৩৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ রাখার অভিযোগে দুটি মামলা করেছে।
এছাড়া, দুদক তাদের দুই ছেলে আহসানুল আলম এবং আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে মামলা করেছে।
Leave a Reply